Header Ads

হাসান আজিজুল হক-এর ছোটগল্প ‘ঘরগেরস্থি’

                                        ঘরগেরস্থি

                                 হাসান আজিজুল হক



 লঞ্চ থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে রামশরণ সপরিবারে বাঁধের উপর উঠে আসে। এর মধ্যে তিনবার সে পা ফস্কে পড়ে গেছে। হাঁড়িকুঁড়ি, হুঁকো-কল্কে, কুল্লে সের সাতেক চাল, বিছানাপত্র সব জলে ভিজে জবজবে হয়ে গেল। বইতে সুবিধে হবে বলে রামশরণ একটা বাঁক জোগাড় করেছিল। শহরে ফলের বাজারে গিয়ে চেয়েচিন্তে পেয়ে গিয়েছিল দুটো ভাঙা ঝুড়ি। এই ঝুড়ি দুটোতেই তার সংসার মোটামুটি ধরে গেল। অবশ্য বউ, বারো বছরের ছেলে, দশ বছরের মেয়ে আর তিন বছরের কনিষ্ঠ কন্যাটিকে বাঁকে জায়গা দিতে পারা যায়নি। বরং বাঁকে যা ধরেনি তাই ওদের কোলে পিঠে হাতে কাঁধে ধরিয়ে দিয়েছিল রামশরণ। ছেলেটি নিয়েছিল আধা কাঁদি কাঁচা কলা, মেয়েটির হাতেও কি যেন দিয়েছিল সে। কিন্তু বউয়ের ভারটাই বেশি হয়ে গেল। ছোট মেয়েটা বাঁ কাঁকালে, ডানদিকে সংসারের টুকিটাকি জিনিস।

বাঁধে উঠে হাঁফ ছাড়লো রামশরণ। ভানুমতি ডান কাঁখটা ফাঁকা করে একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য দাঁড়ালো। জিনিসপত্রগুলো মাটিতে নামিয়ে ফেলেছিল সে। কোলের মেয়েটাকে নামাতে যেতেই সে দুহাতে আঁকড়ে ধরলো মাকে।

ভানুমতি বলে, তুই কি আমারে চিব্যায়ে খাবি-হাঁ লা? জবাবে মেয়ে খিমচি দিয়ে ভনুমতির শুকনো স্তনের বোঁটা এমন করে চুষতে শুরু করে যে, যন্ত্রনায় তার চোখে জল এসে যায়। ধাঁই ধাঁই করে মেয়ের পিঠে চড় বসিয়ে বলে, ছাড়, ছাড়, ছেড়ে দে রাক্ষুসি —  বলে সে স্বামী পুত্র কন্যার সামনেই বুক উদোম করে ফেলে। রামশরণ নিস্পৃহ চোখে সে দিকে পিটপিট করে চেয়ে বলে, মারিসনা, কি আছে মাইয়্যাটর দেহে, অমন করে মারলি বাঁচপে?

ভানুমতি বলে, মলে তো আপদ যায়। ও মাইয়্যা তোমার মরবে ভাবছ। ভানুমতিকে দোষ দেয়া মুসকিল। গত ন’মাস ধরে এই মেয়ে তার কোলে চড়ে আছে। ভনুমতি বিনা সঙ্কোচে তার কোমরের কষি একটানে খুলে ফেলে রামশরণকে দেখায়, দেহো দিহি কেমন ঘা করে দেছে কোমরে।

সত্যিই কাঁকালটায় ঘা হয়ে গেছে। এমনিতেই কিন্তু আজকাল আর ভানুমতির কোলে মেয়েটাকে আলাদা করে চেনা যায় না। কদাকার কুৎসিত একটা টিউমারের মতো ভানুমতির বাঁ দিকের পাঁজরে লেগে আছে। উলঙ্গ মেয়েটার দুদিকের কুঁচকির চামড়া ঢিলে হয়ে ঝুলে পড়েছে — মাথায় একটি চুলও নেই — সমস্ত শরীরে শুকনো দাদের মতো ঘা। রামশরণ জানে মেয়েটা মরছে, ভানুমতিও জানে, শুধু অভ্যাস আর নেহাৎ ওরা মানুষ বলে বয়ে বেড়াচ্ছে।

রোদটা চড়চড় করে উঠে গেলে তলগাছের মাথায় ছায়া কুঁজো একটা জানোয়ারের মতো সুট করে গুড়ির কাছে চলে গেল। হালকা, গরম স্বস্তিহীন ছায়া সামান্য একটা জায়গা জুড়ে। রামশরণ সেই ছায়াটুকুর মধ্যেই পুরো পরিবারের জায়গা কুলিয়ে ফেললো। বড় ছেলেটাকে টেনে নিল কোলের মধ্যে, ভানুমতি শাড়িটা কোলের মধ্যে জড়ো করে রামশরণকে আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে বসলো আর বড় মেয়েটা সেঁটে রইলো মায়ের গায়ে। এইটুকু জায়গার মধ্যে পুরো পরিবরটি এঁটে যেতে পারে এ এক তাজ্জব ব্যাপার। রামশরণ হুঁকো কলকি বের করে তামাক সাজতে বসলো।

গরম বাতাস আসছিল থেকে থেকে। দম আটকে আসছিল তখন, রামশরণ ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখছিল, বললো — কি যে দ্যাখবো বাড়ি গিয়ে! ভানুমতি বলে, দ্যাখবে আবার কি? দ্যাখবে কিছুই নাই।

আহারে কত যেন ছেলো আমাদের?

ভানুমতি অতিষ্ট হয়ে দু হাতে মেয়েটির মাথা ধরে জোর করে একটা স্তন থেকে তার মুখটা সরিয়ে দিতেই মেয়েটা তার এই দেশের দিকে, মা বাবা দাদা দিদির দিকে ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করে ঠিক স্থিতিস্থাপক রবারের মতো অন্য স্তনটায় মুখ লাগিয়ে চোঁ চোঁ টানতে থাকে।

ইকি জন্মের খাওয়া খাচ্ছে গো? কথাগুলো ভানুমতি কাউকেই বলে না কিন্তু মেয়ের তেলো মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে উকুন খোঁজার চেষ্টা করে।

ইতিমধ্যে রামশরণ হুঁকো ধরিয়ে ফেলেছে। চোখ বুঁজে আরাম করে সে টানতে থাকে। শূন্য মাঠ আর ফাঁকা আধশুকনো খাল, আজন্মা ও অনাবাদী বছরেরে পাটকিলে রঙের বদমেজাজি ঘাসের জঙ্গল, লোনা জলে ডোবা ঝাঁঝালো অফলা বিল — এইসব তীব্র রোদে মিশে গিয়ে নেশার মদের মতো রামশরণের ভিতরে ঢোকে তামাকের ধোঁয়ার সঙ্গে। সে চোখ বন্ধ করে বলে, কতদিন সংসার করতেছিরে ভানু? ভানুমতী চমকে উঠে তাড়াতাড়ি কোলে জড়ো করা শাড়ি তুলে নিয়ে গা ঢেকে ফেলে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রামশরণের দিকে তাকায় সে। তখন রামশরণ মজার কাণ্ড করছিলো। হুঁকো টানা বন্ধ করে ছেলেটাকে বুকের খুব কাছে টেনে নিয়ে আঁকাবাঁকা গাঁট-ওঠা আঙ্গুলে তার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে সে পরিবরের সন্তানদের বয়সের হিসেব আরম্ভ করে দিয়েছে।

জগোর বয়স হয়েছে তের বছর — না রে? তার আগে দুটো গেছে। মনো মরিছে পাঁচ বছর বয়সে — সেই যেবার গাঁ সুদ্ধ লোক শামুক-গুগলি আর শাপলা খাইছিলো সারা বছর। মনোর ছোট পুন্নিমে মরিছে তিন বছর বয়সে। বিয়ের বছরই তো পেটে আইছিলো মনো। তাহলি আমাদের বিয়ে হইছে আঠারো বছর।

গত বছর এই সময় ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিলো। ব্যাপার যা ঘটেছিল, রামশরণ বাপের জন্মে কোনদিন শোনেও নি, দেখা তো দূরের কথা। দরজি বাড়ির ছেলে রশিদ এসে গোয়ালের গোঁজ থেকে দুধেল গাইটিকে খুলে দড়ি ধরে নিয়ে গেল যেন চড়াতে নিয়ে যাচ্ছে মাঠে। রামশরণ বলে, অ বাবা রশীদ, করিতিছিস কি বাবা, গাইটোকে নিয়ে যাচ্ছিস কনে? রশিদ কিছু বলেছিলো কিনা মনে নেই — বেচারি বোধহয় লজ্জায় কিছু বলতে পারেনি — একবার শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়েছিল বুঝি। কিন্তু দুপুরে যখন খেতে বসে রামশরণ, সেইসময় পশ্চিমবাড়ির বিদায়চরণ নিজেরই বাড়িতে খড়ের গাদায় পুড়ে পোড়া কয়লার মতো হয়ে গেল;- ঘটনাটা ঠিকমতো বুঝে ওঠার আগেই চার পাঁচটা ছেলে এসে বলে, কাকা, আর কত খাবা? তাতে রামশরণ বলে, ক্যানো বাবারা, কোথাও যেতে হবে? এতে অন্য ছেলেগুলো চুপ করে থাকলেও, বসন্তের দাগঅলা অল্পচেনা ছেলেটা বলে বসলো, কাসর থালাটা — যেটায় খাচ্ছো, ওটা আমাদের লাগবে। দেরি করতি পারতিছি না, অন্য বাড়িতে যাতি হবে। তাই কচ্ছি তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে থালাটা দাও।

বড়ো বড়ো ফোঁটায় রামশরণের চোখ থেকে জল পড়ে তার ভাতই লোনা হয়ে গেল। মোটামুটি আধঘন্টার মধ্যেই উৎখাত হয়ে গেল সে। ঐ যে দুপুরে লোনা লেগেছিলো মুখে, কোন জল কি অন্য কিছু পাওয়া গেল না স্বাদ ফেরানোর। পথে পথে ঘুরে, নদীতে নদীতে আকুপাকু করে, সীমান্তে চেঁচিয়ে, সীমান্ত ছাড়িয়ে মুখে পাথরের মুখ এঁকে মানুষের সারিতে নরক পর্যন্ত অপেক্ষা করে, দাঁড়িয়ে বসে চলে হেঁটে কোনভাবেই যে মানুষ পারে নি নুনের ঝাঁজ থেকে মুক্তি পেতে — একবছর পরে বাড়ির কাছে এসেই কেমন দিব্যি হুঁকো ধরিয়ে সেই মানুষ সন্তানদের বয়সের হিসেব নিতে শুরু করেছে।

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছেলেমেয়েদের খোঁজখবর করায় ভানুমতীর ভিতরে সেই রহস্যময় দরজা হাট হয়ে খুলে যায় যেখানে সচরাচর দৃষ্টিহীন অন্ধকারই থাকে। বুক টনটন করে ওঠে ভানুমতীর। হঠাৎ মনে পড়ে যায় ছ’টি ছেলেমেয়ে ছিল তার। গরম ভাপওলা রোদের দিকে চেয়ে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলেও ভানুমতী অবাক হয় যখন দেখে প্রত্যেকটি ছেলেমেয়ের মুখই তার মনে পড়ছে। বড় ছেলেটার থুতনির উপর একটা তিল ছিল, মেয়ের কপালে ছিল একটা বিশ্রী আঁচিল আর ছোট ছেলেটার ডান পায়ের একটা আঙুল অন্য আঙুলগুলোর চেয়ে উপরে ছিল —  এসবও স্পষ্ট মনে পড়ল তার।

ভানুমতী বলে, ভগোমান ঠিক আধাআধি ভাগ করে দেছে। ছ’টার তিনটে আছে। রামশরণ কিছু বললো না, ছোট মেয়েটার দিকে চাইলো একটু অন্যমনস্কভাবে। মেয়েটাকে এখন ঢেকে নিয়েছে ভানুমতী বউমানুষের মতো।

রামশরণ একটু ভেবে নিলো, একটু চিন্তাভাবনা করে শেষে বললো, গাছ থাকলি আবার ফল ধরে। গাছটাতো আছে!

দেখে মনে হয় ভানুমতী এই কথায় লজ্জা পেয়ে গেছে। সে আড়চোখে চাইছে রামশরণের দিকে। রামশরণের পরণে আছে রং জ্বলে-যাওয়া একটা গামছা। তার বেঢপ লম্বা হাত দুটোর পেশি দড়ির মতো পাকানো, ছোট ছোট চুল বিবর্ণ প্রায়, সবগুলো দাতই পড়ে গেছে তার।

বাড়িটা কি আছে? কি যে দ্যাখবো গিয়ে!

থাকতিও পারে।

শুনিছি পরে পোড়ায়ে দিছিলো মেলিটারি গিয়ে। তাহলিও ভিটেটা আছে কি বলিস?

থাকতিও পারে — ভানুমতী আবার বলে।

থাকতিও পারে বলতিছিস ক্যানো? থাকবে নাতো যাবে কনে? একটু ক্ষেপে উঠে রাগী গলায় বলে রামশরণ।

তাহলি আছে — ভানুমতী আবার বলে

এতেও রাগ বেড়ে গেল রামশরণের। কিন্তু সে কথা কাটাকাটি করতে চাইলো না। বললো, কি কষ্টই না পাইছি এই নটা মাস। এ্যাহন, এই এ্যাতো কষ্টের পর কি দ্যাশে যাইয়ে বসতে পারবো না কস?

ভানুমতি এইবার ঝেঁজে উঠলো, কি সুখটা জেবনে পাইছো আমারে এট্টু কওতো? প্যাট ভরি খাতি পাইছো কোনদিন, পরের বাড়ি খেটে খেয়ে জেবন গেল। পোলাপানদের কোনদিন দুটো ভালো জিনিস দিতি পারিছ, এট্টু ভালো জামা-কাপড় দিতি পারিছ কও?

রামশরণও সমান তেতে জবাব দিলো, আরি বাপু, ভিটেটা তো নিজের ছেলো, সারাদিন পর নিজের ঘরে শুয়ে তো থাকতি পারতাম-

ভানুমতি একটানা কিছু বকে গেল, বলো, কেমন করে তোমার মনো মরিছে? পেরথম ছোওয়ালটা কেমন বিনি ওষুধে বিনি পথ্যে মরিছে, কও? পুন্নিমে মরিছে কেমন করে? সঙ্গে সঙ্গে রামশরণ বলে, তাহলি বল, দয়াল মরিছে কেমন করে? কই থামলি ক্যানো, বল, কেমন করে মরিছে? বেশি দিন তো না। এই তো সেদিন মলো পোলাটা। বল্ কেমন করে মরিছে?

ভানুমতি একেবারে থেমে গেল। কোন কথা বলতে পারলো না সে।

তবে? রামশরণ বলে, বাড়িতে মরলি অমন শ্যাল কুকুরের ছানার মতো ফেলে তো দিতি হয় না।

ভানুমতী চোখে আঁচল চাপা দিলো।

কেঁদে কোন লাভ নেই বুঝলি। তিনডে এ্যাহনো বেঁচে আছে। ফিরে তো আইছি আবার। ইন্ডে গেলাম, কবে মরে ভূত হবার কথা, ফিরে আসলাম। দ্যাশে ফিরে কোথা ইষ্টিশান, কোথা জাহাজঘাট, রিলিফের লাইন আর লোকের কাছে দ্যাও দ্যাও করা — তার চাইতে নিজের ভিটিতে —  একটু উত্তেজনা হয়েছিল রামশরণের, হুঁকোটা নিভে গিয়েছিল, ফের ধরিয়ে নিল সে। ঐ দুপুরে রোদ ছিল অসহ্য, স্যাঁতসেঁতে দেশ, সবকিছু ঠিক পুড়ে যায় না, কিন্তু ভেজা মাটি থেকে বিশ্রী ভাপ উঠতে থাকে, আধ শুকনো খানাখন্দ থেকে গরম জলীয় বাষ্প ধোঁয়ার মতো ভাসতে থাকে, বাঁদিকে গাঙ রোদে জ্বলছে বলে সেদিতে চাইলেই চোখে আচমকা ধাক্কা লাগে — এইসব কারণে রামশরণের চোখে যন্ত্রণা হচ্ছে, পেটের ভিতরে যন্ত্রণ, মাথায় ঝিমধরা বেদনা, সে খানিক অভিভূত হয়ে, হুঁকো টানতে টানতে ভানুমতীর সামনে একটি চমৎকার জগৎ খুলে দিতে থাকে। রামশরণের ভঙ্গি রূপকথা বর্ণনার, সামনের ময়লা নোংরা জগৎটা একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে, সেখানে তার বদলে জাগছে শক্ত মজবুত বাড়ি, ঘর-দুয়োর যা ঝড়ে বন্যায় টিকে থাকবে। খাদ্য এবং বস্ত্রের কোন অভাব থাকবে না। অবশ্য জগৎটা খুবই খাটো, রামশরণের কল্পনা আর আকাঙ্ক্ষার মাপমতো।

ভানুমতী মেয়েটাকে আর ঠেকাচ্ছে না। কাপড়-চোপড় ঠিকঠাক করে নিয়ে, কপালের উপর পর্যন্ত ঘোমটা টেনে চুপচাপ শুনছে। তার মুখের কঠিন রেখাগুলো নরম হয়ে আসে। অনিদ্রা, দুশ্চিন্তা আর অনশনের জন্যে গজিয়ে ওঠা চোখের কোণের গভীর কালো রেখা মুছে গিয়ে চোখ দুটো কেমন টানা টানা মনে হতে থাকে।

রামশরণ তার বাপের গল্প বললো, তার বাল্যের কেচ্ছা শোনালো, সন্তানদের কথা বললো ফেনিয়ে ফেনিয়ে। শুনতে শুনতে ভানুমতীর চোখে বারে বারে জল চলে এলো, সে মোছবার চেষ্টাও করলো না।

ভাবনা কি? ঠিক আবার গুছিয়ে বসবানে — বললো রামশরণ। এত সব কথার পর ভানুমতীও সাধ মিটিয়ে স্বপ্ন দেখে নিল। উত্তর পূব আর পশ্চিম পোঁতার তিনটে ঘর পরিস্কার ঝকঝকে উঠোন ঘিরে। ছেলে বউ নিয়ে আছে একটায়, একটায় তারা নিজেরা আছে, উত্তরেরটা ফাঁকা, জামাই মেয়ে এলে ব্যবহার করা যাবে। বাংলাদেশের বউ ভানুমতী, কতদিন ধরে সংসার করছে — কী বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার! সে কি জানে না কেমন হতে হয় সুখের সংসার? গোয়াল, গাই-গরু, হাল-বদল, জমি-জমা, পুকুর ভর্তি মাছ আর গোলাভরা ধান দুরস্থিত স্বপ্নের মতো ভানুমতীকে প্রচণ্ড আকর্ষণে টানে। ভানুমতীর চোখ বিশাল গভীর দীপ্ত, প্রায় মেঘভরা, জলভরা শ্রাবণের আকাশের মতো। রামশরণ উঠে দাড়াতে গিয়ে উঃউঃ শব্দে বসে পড়ে। কিন্তু সে বসেও থাকতে পারে না, তাকে খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হয়। কিছুদিন থেকে তার কোমরে একটা খিঁচ ব্যথা হয়েছে, বেশিক্ষণ বসে থাকার পর উঠে দাঁড়াতে গেলেই এই ব্যাপার। ভানুমতী বলে, কি হইছে, দুঃখ পাইছ? রামশরণ বিকৃত মুখে শুয়ে শুয়েই কোমর টানটান করার চেষ্টা করে, উঠে বসে ঘাড় নিচু করে থাকে কিছুক্ষণ, শেষে দু’হাতে কোমড় ধরে উঠে দাঁড়ায়।

উঃ, শালার বেথাটা! অস্ফুটে মন্তব্য করলো সে। রামশরণ তার মাথাটা কিছুতেই বুকের ওপর ঝুঁকে পড়তে দেবে না এমনই রোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার সেই চেষ্টায় ঘাড়ের পিছনে দুগোছা দড়ির মতো শিরা থর থর করে কাঁপতে শুরু করে, হাড়-সেকা রোদে পুড়তে পুড়তে তার খালি গায়ের চামড়াও সেই কষ্টে জিল জিল করে নড়ে চড়ে ওঠে। তবু সে বাঁক কাঁধে নিয়ে, প্রতিটি জিনিস বৌ ছেলেমেয়ের হাতে আগের মতো ধরিয়ে দিয়ে বাঁধ ধরে টুক টুক করে এগিয়ে গেল। খুব কাছেই রামশরণের গাঁ-উঁচু বাঁধটা চোখের উপর বেধে গেছে বলেই গাঁ-ঘর দেখতে পাওয়া যায় না। রামশরণের চেষ্টা হলো বাঁকটা তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাবার। এমন তেজে সে হাঁটতে থাকে যে, মনে হয় দরকার হলে বাড়িতে গিয়েই সে তার জীবনের সর্বশেষ নিঃশ্বাসটি ফেলবে। তার বুকের ভিতর গুড়গুড়ুনি শুরু হলো, কাঁটা মুরগির মতো ধড়ফড় করতে থাকে তার হৃৎপিণ্ড, সাপের মতো কিলবিলিয়ে ওঠে নাড়িভুঁড়ি। বাঁকটা পার হয়েই দাঁড়িয়ে পড়লো রামশরণ, চোখ পিটপিটিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখলো; রোদের জন্য কিছু দেখতে পাচ্ছিল না সে।

ফিরে তাকালো সে ভানুমতীর দিকে, গাঁ কই রে? ভানুমতী বলে, আসে গিছি নাকি?

রামশরণ ধমক দেয়, চোহে দেহিস না? গাঁটা গেল কনে?

বাঁধ থেকে নেমে পড়লো সে সপরিবারে। গাঁয়ের চিহ্নমাত্র ছিল না — এই কথাটা সে ঠিক বলছিল না। আসলে, দূর থেকে দেখতে পায়নি রামশরণ। এখন সে ঘরবাড়ির অবশেষ কিছু কিছু দেখতে পাচ্ছিল। কালো মাটির ভাঙাচোরা ভিটে, আধপোড়া খুঁটি, তোবড়ানো এনামেলের বাটি, ভাঙা ঝুড়ি, ঝাঁটা, উনুনের পোড়া মাটি আর ছাই — এসব তবে কিসের চিহ্ন? রামশরণ ঠিকই চিনতে পেরেছিলো। কিন্তু সে বোবা হয়ে গিয়েছিলো এতো কাছে এসেও নিজের ভিটেটাকে চিনতে না পেরে। অবাক হয়ে ভাবছিলো এতো ছোট ছিলো নাকি তাদের গাঁ? মাত্র এই কয়টি ঘর? বাড়িঘরগুলোর ভিতর দিয়ে যে অসংখ্য গলি ছিলো — যেখানে সেখানে কুমড়ো আর লাউয়ের মাচা —  খোলা খামারে গরু বাঁধা, এতগুলো ডোবা! এসব গেল কোথায়? সব উবে গিয়ে এই গুটিকতক ন্যাংটো ভিটে? রামশরণ বাঁক কাঁধে দুলতে দুলতে বলে, এইডা না?

ভানুমতী এদিক-ওদিক চেয়ে হৃদয়চরণের বাড়ির দিকের গলিটা খুঁজতে থাকলে রামশরণই আবার বলে, দুরো, তুলসীদার ভিটে এটা। রামশরণ একবার এ ভিটের কাছে গিয়ে বললো, হৃদয় খুরোর বাড়ি, একবার সে ভিটের কাছে গিয়ে, এইডা পেল্লাদের মনে হয় — এইরকম চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত সে আধা পাগলের মতো চেঁচাতে শুরু করে। কাঁধের বাঁক তার হাড় ফাটিয়ে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে, ভিটেটা গেল কনে? আঁ? অ ভানু, দ্যাখনা এট্টু খুঁজে। বেচারার জল এসে গেলো চোখে।

সান্ত্বনা দেবার মত ভানুমতী বলে, ক্যানো মিছে খুঁজে মরতিছ? বাড়ি ঘরদোর কি আছে যে ঘরে গিয়ে বিছানা পেতে শুয়ে পড়বানে? সব ভিটেই তো সমান, শরিকে কি ঝগড়া করতি আসতিছে। কথাটা ভাল করে ভেবে বিচার করে দেখল রামশরণ। কোন বাড়িই যখনই আস্তো নাই, ভাগাভাগির জন্য দ্বিতীয় প্রাণীও যখন নেই হাজির, তখন নিজের ভিটের জন্য এতো খোঁজ-খবরের দরকারটা কি? কিন্তু যেন দুর্দান্ত কৌতুহলেই রামশরণ আতিপাতি খুঁজে দেখছিল, কোথায় যেতে পারে তার সাধের বাড়িটার পোড়ো ভিটে, পা গজিয়ে পালিয়ে তো যেতে পারে না। নিশ্চয়ই ঘাপটি মেরে আছে এখানে। পোড়া খুঁটি, ভাঙা বাঁশ, টিনের বাসন-কোসন, মাটির শানকি — এই সবের মধ্যে। বোশেখ মাসের প্রচণ্ড রোদ, হুহু হাওয়া আর বিরাট নিষ্ফলা অঞ্চল এমন করেই কি তার ভিটেটাকে লুকিয়ে ফেলতে পারে যে খুঁজে মিলবে না? বাড়ি তো জঙ্গম নয়।

রাত দশটার দিকে খানিকটা হালকা হয়ে গেল রামশরণের পরিবার। ভানুমতী প্রচণ্ড তেজের সঙ্গে শুরু করলেও বেশিক্ষণ চালিয়ে যেতে পারলো না, নেতিয়ে পড়লো সে। তাছাড়া এই খোলা মাঠে চিৎকার করে একা একা কান্না কোথাও যেন ঠিক পৌঁছোয় না। ভানুমতী কিছুক্ষণ চেঁচিয়ে কঁকিয়ে কেঁদেই বোধহয় বুঝলো, নালিশ ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে দেয়া তার কর্ম নয়। খানিক পরেই রামশরণ ও তার তীক্ষ্ণ বুকফাটা চিৎকার শোনে না। ভানুমতী ফাটা ফেঁসে যাওয়া গলায় বারবার ডাকছিলো, অরু, অরু রে, কোথায় গেলি মা। সঙ্গে সঙ্গে বিকৃত হয়ে উঠছিলো তার মুখ; গলায় ঘাড়ের আর মুখের মাংশপেশি টানটান হয়ে যাচ্ছিল যেন তার বুকের ভিতর রয়েছে কঠিন কোন ভার যা ভানুমতী চাইছে উগড়ে ফেলতে। খুব প্রিয়জন মরে গেলে হয়তো প্রথম কয়েক ঘণ্টা শোক এইরকম পাথরের মতোই বুকের ভেতর বেড়ে ওঠে।

ছোট মেয়েটার নাম ছিল অরুন্ধতী। এমন সুন্দর নাম নিয়ে সে মরে গেল কোন সাড়াশব্দ না করে। ভানুমতী একটা পড়ো ভিটের ওপর ইট পেতে রান্না চড়িয়েছিল সন্ধ্যের পরে। শহর থেকে আসার সময়ে রিলিফের যে চাল সে যোগাড় করেছিলো তাই ফুটিয়ে নিয়েছিলো। মেয়েটা পেট পুরে খেয়েছিলো সেই ভাত। খেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়েছে, বড় ছেলেমেয়ে দুটোও অসাড় হয়ে পড়ে আছে, ভানুমতী রামশরণকে খেতে দিতে যাবে — তখন দেখা গেল মেয়েটা মরে গেছে। ঘুমের মধ্যেই চলে গেছে সে। ভানুমতী ত্রস্ত হাতে মেয়েটার বুকে হাতের পাতা রেখে দেখলো, নাকে হাতের উল্টো পিঠ রাখলো, ঝুকে পড়ে মেয়ের মুখের উপর নিজের মুখ নিয়ে গেল। এই সময়ের মধ্যে টু শব্দ করলো না ভানুমতী। পর্যবেক্ষণ শেষ করে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে কেমন বুনো চোখে একবার রামশরণের দিকে তাকালো, তারপর বুকফাঁটা কান্নায় ভেঙে পড়লো।

ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ভানুমতীর প্রায় সমস্ত শোকটাই বেরিয়ে গিয়ে সে হালকা বোধ করে। কিন্তু সেই আক্রোশভরা ভয়াবহ শোক যায় কোথায়? কোথায় যে মিলিয়ে যায়। রামশরণ এখন আর কোন চিৎকার শোনে না। একটা চটের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের ঝকঝকে তারা দেখতে দেখতে সে ভানুমতির মৃদু একঘেয়ে গোঙানি শুনতে থাকে। নদীর দিক থেকে খোলা মাঠের উপর দিয়ে হুহু করে হাওয়া ছুটে আসে, প্রায়-নেভা ইটের উনুনের ছাইয়ের তলায় লাল গনগনে আগুন অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে ওঠে। তখন ভিটেটা চাপা আলোয় আবছা দেখা যায়। রামশরণ চেয়ে দেখে, বড়ো ছেলেটা হাত পা ছড়িয়ে ঘুমায়, বড়ো মেয়েটা কোলের মধ্যে গুটিয়ে নেয় নিজেকে আর তাদের পাশে প্রায় গায়ে গায়েই মরা মেয়েটা পড়ে আছে। মাথায় একটা চুল নেই, কাঠির মতো সরু সরু হাত পা, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে চামড়া ঝুলে পড়েছে, পেটে এখনও রিলিফের ভাত ভরা আছে। ওহোহো জাতীয় একটা অতর্কিত চিৎকার করে রামশরণ কেঁদে উঠতে চাইলো। খুব বেখাপ্পা শোনায় সেটা। রামশরণ চুপ করতেই উঁচু বাঁধে বাধা পেয়ে বাতাসে সে হুড়মুড় করে ফিরে গেল সেই শব্দ শোনা যায়। আশেপাশে কোন বড় গাছপালা নেই, বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ নেই সেজন্য। কী রকম হাহাকারের মতো বাতাস ছোটাছুটি করে বেড়ায় শুধু। ভানুমতীর গোঙানি একটানা চলছে, এখন সেটা আরো মৃদু। অসম্ভব ক্ষিদে বোধ করলো রামশরণ।

উঠে বসে সে কথাবার্তা চালানোর চেষ্টা করে, মরে হাড় জুড়োল মেয়েটার, কাঁদিসনে, আমাদের ভাগ্যে তো তা নেই। নাড়ি জ্বলে যাচ্ছিল তার। সব ভাত কি এখন ফেলে দেবে ভানুমতী? তাহলে তো মরা মেয়ের পাশে তাকেও জায়গা নিতে হচ্ছে আজ।

ভানুমতী কেঁদে চললো ইনিয়ে-বিনিয়ে। অস্থির হয়ে আবার শুয়ে পড়লো রামশরণ। যখন ঘর থাকে, বাড়ী থাকে, শিশুর কান্না থাকে, গৃহপোষ্য পশু, ক্ষেত আর কিছু কিছু ফসল থাকে, আকাশ তখন ছোট, নীচু ছাদের মতো আর এখন শস্যহীন, বসতিহীন ভুখন্ডের বহু উপরে কুচকুচে কালো বিশাল আকাশ। রামশরণ সেই আকাশের দিকে চেয়ে ভেবে চললো ভানুমতী তৈরি ভাত তাকে খেতে দিবে কিনা।

কিন্তু উঠে বসলো ভানুমতী, শানকি টেনে নিয়ে ভাত বাড়লো দুজনের জন্য। ভাত বেড়ে সে চুপচাপ বসে থাকলো উদাসভাবে। রামশরণ দেরি করলো না। নিজের কাছে একটা শানকি টেনে নিয়ে আর একটা এগিয়ে দিলো ভানুমতির দিকে। কোন কথা না বলে ঠাণ্ডা কড়কড়ে ভাঁটার মতো শক্ত বড়ো বড়ো শক্ত বিস্বাদ রিলিফের চালের ভাত নুন মাখিয়ে খেতে শুরু করে সে। কচ করে কাঁচা মরিচ দাতে কেঁটে নেয় রামশরণ, হুহু করে মুখে জল চলে আসে — কন্যা শোক ভুলে গিয়ে খুব মন দিয়ে ভাত খেয়ে যায় সে। আঁচল দিয়ে মুখ মুছে শুকনো করে তুললো ভানুমতী কিন্তু ভাতের প্রথম গ্রাসটা মুখে তুলতেই চোখ আবার ভর্তি হয়ে গেল জলে। সুবিধে হবে না বুঝে আর মুছলো না ভানুমতী, ভাতে আলাদা করে আর নুন মাখানোর প্রয়োজন হলো না তার।

ভানুমতীর পাশেই শুয়ে পড়লো রামশরণ। বিশ্রী আঁশটে গন্ধ বেরুচ্ছে তার গা থেকে। শুকনো ছাইয়ের গন্ধও পাচ্ছে রামশরণ। সে বলে কি করবো এ্যাহন?

ভানুমতী কিছু বলে না। গলগল করে অন্ধকার নামছে আকাশ থেকে। বাঁধে আটকে বাতাস ফিরে ফিরে যাচ্ছে। আর কোন আবাদ হবে না, চাষ হবে না, কেউ আসবে না এখানে বাস করতে। বিশাল এই ভাগাড়ে রামশরণ হঠাৎ এতো ভয় পেয়ে গেল যে, সে ভানুমতীর কাছে ঘেষে এগিয়ে গেল।

কি করবানে এ্যাহন ওডাকে নিয়ে? ভানুমতী? ভানুমতী নতুন করে কেঁদে বলে, ওরে এট্টু আগুন দেবানা? মেয়েডা এ্যাট্টু আগুন পাবে না, হায় রে।

রামশরণ চেয়ে দেখলো ছাইয়ের নিচে আগুন খুব তাড়াতাড়ি নিভে যাচ্ছে। সে বললো পুড়িয়ে আর কি সদগতি হবেনে? ভগোবান ফগোবান নাই বুঝলি। কাল সকালে এট্টু গর্ত কে পুতে দেবানে —  শিয়েল টিয়েল যাতে না খাতি পারে। যাবে পঞ্চভুতে মিশে।

মৃত মেয়েটা ভিতরে ভিতরে খুব শক্ত হয়ে যায়। মেয়েডা আমার পরাণ ছিলো গো-ওরে পোড়াও তুমি-ভানুমতী ভীষন কাঁদতে কাঁদতে বলে, কেমন করে আমার দুলাল মরিছে তোমার মনে নাই? ছেলেডা ইন্ডেয় শুকিয়ে মলো-জংগোলে চেলে ফেলে দেলাম।

স্বাধীন হইছি আমরা — ঘৃণায় আর রাগে রামশরণের গলার আওয়াজ চিড় খেয়ে গেল, স্বাধীন হইছি তাতে আমার বাপের কি? আমি তো এই দেহি, গত বছর পরাণের ভয়ে পালালাম ইন্ডেয় — নটা মাস শ্যাল কুকুরের মতো কাটিয়ে ফিরে আলাম স্বাধীন দ্যাশে। আবার সেই শ্যাল কুকুরের ব্যাপার। ছোওয়াল মিয়ার হাত ধরে আজ ইষ্টিশান, কাল জাহাজঘাট — রামশরণের কথা থেকে ছড়াৎ ছড়াৎ শব্দে ধার ছিটোতে থাকে, স্বাধীনটা কি, আঁ? আমি খাতি পারলাম না — ছোওয়াল মিয়ে শুকিয়ে মরে, স্বাধীনটা কোঁয়ানো? রিলিফের লাইনে দাঁড়াও ফহিরের মতো, ভিক্ষে করো লোকের বাড়ি বাড়ি।

ভানুমতী বলে, কেমন করে এহানে বাস করবা — কি খাবা এহানে — অরুন্ধতী রে —

রামশরণ বলে, ভাবনা কি তোর? সরকার জমি দেচ্ছে, গাড়ী গাড়ী চাল দেচ্ছে, বাঁশ বেড়া টিন দিয়ে ভিটেয় বাড়ী তুলে দেচ্ছে, তারপর আকাশ থেকে পড়বেনে একজোড়া জুয়ান বলদ।

ভানুমতী ককিয়ে কাঁদে, অ মা অরুন্ধতী, কোথায় গেলিরে তুই? দু তিনবার চিৎকার করে আবার গলা নামায় ভানুমতী, সাপের মন্ত্র পড়ার মতো একঘেয়ে ঝিম মারা সুরে গুন গুন করতে থাকে। শুনতে শুনতে অসহ্য হয়ে ওঠে রামশরণের। সে বলে, অ ভানুমতী, আমি বলতিছি কি — স্বাধীন হইছি না কি হইছি আমি বোঝবো কেমন করে? আগে এট্টা ভিটা ছিলো, এখন তাও নেই। আমি স্বাধীনটা কিসি?

কান্না থামিয়ে ভানুমতী খুব উদাস ম্রিয়মান গলায় বলে, ক্যানো সরকার থে পাবে না কোন কিছু?

এই যে পাইছি সাত সের চাল আর ইন্ডে থেকে দিছে কটা কম্বল। এই পাইছি।

ঘর দোর বানাতে কিছু দেবে না আমাদের?

তোর কি মনে হয়? রামশরণ পাল্টা জিজ্ঞেস করে। এখেনে তোরে কি দেবেনে ক।

তবে যে কয় গেরামে গেরামে ঘর বানিয়ে দেবে।

আচ্ছা আচ্ছা দেচ্ছে, রামশরণ বলে, তিন দিনের চাল আছে তোর। চালটা ফুরিয়ে গেলে কি করবি? চাল ফুরোলি ভিক্ষে করবি কনে? কেউ আছে ইদিগে? তিনদিন পর চাল নে আসছে কি সরকারের লোক? বাস বেড়া আনতিছে? ভাবসাব যা দ্যাখলাম সরকারের লোক যদি আসেও, ততদিনে তোর আমার হাড়ে ঘাস গজিয়ে যাবেনে।

ভানুমতীর গা থেকে উৎকট গন্ধ আসছে। তার পাশে শুয়ে রামশরণের গলা পর্যন্ত শোক ফেনিয়ে ওঠে। রান্না করার জন্য ভানুমতী জোগাড় করেছিলো কটা বড় শুকনো ডাল। একটা মোটা ডাল আধপোড়া পড়ে আছে। মরা মেয়েটা শুয়ে আছে ঐ ডালটাই পাশে ছেঁড়া চটের উপর। আলাদা করে তাকে চেনা যায় না। আর একটা ডালের মতোই মনে হয়।। রামশরণের চোখ জ্বালা করে ওঠে, শোকের ভার বুকে যেন পাষাণ হয়ে চাপে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার, ভিটের নীচে জোড়া শিয়াল ঘুরে বেড়ায়।

ভানুমতীর গা থেকে মাটি আর ছাইয়ের গন্ধের সঙ্গে মেশা আঁসটে গন্ধটা খুব জোরালো হয়ে উঠলে রামশরণ ধীরে ধীরে মোহে পড়ে। কি একটা ঘোরে ভানুমতীর দিকে সে এগিয়ে গেলে ভানুমতীর চোখ অন্ধকারের মধ্যে জ্বলে। তারার আলোতে রামশরণ সেই চোখে মারাত্নক আক্রোশ এবং অসহনীয় দুঃখ দেখেও জোর করতে থাকে। তখন লাথি ছোঁড়ে ভানুমতী — সে রামশরণকে ফেলে দেয় ছিটকে, মুখে শুধু বলে, লজ্জা করে না তোমার।

মরা মেয়েটার ব্যবস্থা শিয়াল দুটোই করে ফেলেছে। সবাই ঈশ্বরের জীব — এই কথা বললো রামশরণ। ভানুমতী মোটামুটি সান্ত্বনা পেয়ে গেলে ধোঁয়ার দাগ লাগা ইটগুলো ছিটিয়ে দিয়ে উনুনটা ভেঙ্গে দিলো রামশরণ, জিনিসপত্র ঝুড়িতে তুলে বাঁক কাঁধে নিলো। এবারে ভানুমতী নির্ঝঞ্ঝাট, ফাঁকা হাত পা। বড়ো ছেলে মেয়ে দুটোর হাতেও কিছু নেই। বাঁধের উপর উঠে এলো রামশরণ। তার পরিবারটিকে নিয়ে গুটগুট করে বাঁধ ধরে এগিয়ে গেলে সে পিঁপড়ের সারির মতো। যখন বাঁকটা তারা পার হচ্ছিল, তখন, এই বেলা নটার দিকে, গুড়গুড় শব্দে লঞ্চটা ঘাট ছেড়ে চলে গেল।

কিন্তু লঞ্চ ধরে কোথাও যাবার নেই তার। তবে কোথাও সে নিশ্চয়ই যাবে।


No comments

Thanks for your Comment.

Powered by Blogger.